লেবু গাছটায় দেখি ঝেঁপে লেবু ধরেছে। দেখতে ভালো লাগছে। কাঁটাময় অথচ কি জীবন্ত। এর মাঝে আমার হঠাৎই বাবার কথা মনে পড়লো। সন্ধ্যাবেলা কিছু মনে পড়াটা সত্যি খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার। কিছুতেই মন থেকে ব্যাপারটা তাড়ানো যায় না। তার উপর আকাশের সাথে পাল্লা দিয়ে মনটাও ধীরে ধীরে লাল থেকে একবার নীল আর একবার কালো হতে থাকে। মন অবুঝ বুঝলাম তাই বলে সন্ধ্যাকেও অবুঝ হতে হবে? মা দেখছি অবিকল বাবার মতোই জায়নামাজে বসে তসবি জপছে। এ দৃশ্য আমার অনেকদিন দেখা হয় না। অনেকদিন। তাই হয়তো বুকের মাঝে নিশি পাওয়া এক পাওয়া এক পাখি ছটফট করতে করতে জানালো তার বড় অসহ্য লাগছে। চেনা সবকিছুই কেমন যেন অচেনা লাগতে লাগলো। শহরতলির ঝিঁঝিঁ ডাকা এক বিষণ্ণ অন্ধকারে ডুবতে ডুবতে আমি ফিসফিসিয়ে বললাম-বাবা আমার বড় কষ্ট হচ্ছে। বড় কষ্ট।
মা সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে ফাঁকা চেয়ারটায় এসে বসলেন। দু’জন পাশাপাশি বসে অথচ সব কথাই যেন আমাদের ফুরিয়ে গেছে। আমি চুপচাপ বসে বসে লেবুর পাতায় ঘরের আলোর কাঁপন দেখতে লাগলাম। যদিও একসময় সেই অন্য জন্মে আমি আর মা কত গল্পই না করতাম। বাবা একসময় বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘আহ! কী শুরু করলে?’ একি চোখ এতো জ্বালা করছে কেন? ঝালের বাটিতো কেউ পাশে রেখে যায় নি। হঠাৎই মা তার শীর্ণ হাতে আমায় স্পর্শ করে বললেন, ‘বাবু, তুই কী জানিস তোর বাবা তোকে কত ভালোবাসতো?’ ‘জানি।আজ বাদ থাক না সেসব কথা।’ তবুও মা ধরা গলায় বললেন, ‘তোর বাবা শেষকালে বলেছিল-সবাইকে দেখলাম শুধু বাবুটাকেই দেখা হলো না। ওকে বলো ওর উপর আমার কোন রাগ নেই।’ আমি কিছু না বলে বসে রইলাম। বসেই রইলাম। শুধু শুধুই মনে হতে লাগলো কেউ যেন অন্ধকারে ঝালের বাটিটা উল্টে দিয়ে গেছে।
রাত জমে। গাঢ় হয়। আমরা দু’জন চুপচাপ পাশাপাশি বসে থাকি মূর্তির মতো। একসময় হাঁপিয়ে উঠলাম। আমিও হাঁপিয়ে উঠি! বের হচ্ছি মা পিছন থেকে ডেকে বললেন, ‘ কোথায় যাচ্ছিস?’ আমি হাসলাম। মা কী সত্যিই জানে না আমি কোথায় যাবো? বাইরে বেশ বাতাস বইছে। কার্তিক মাসেই দেখছি এবার শীত চলে এলো। চেনা গলিটার সামনে এসে খেলার মাঠটাকে না পেয়ে বড্ড অবাক হলাম। সময় সর্বভুক জানি, তাই বলে সব এভাবে গিলে খাবে? তবু শেষ মাথায় রঞ্জুদের বাড়িটা আগের মতোই আছে দেখে ভালো লাগলো। বরই গাছওয়ালা টিনশেডের বাড়িটা আমায় যেন এক ধাক্কায় গহনে ডুবিয়ে দিলো। শুধু কলতলাটা মনে হলো অনেকদিন কেউ ব্যবহার করে না। আজকাল হয়তো ভিতরে পানির ব্যবস্থা হয়েছে। কড়া নাড়তেই রঞ্জু এসে দরজা খুললো। কতদিন পর দেখা। কতদিন। ও আমায় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। আহ! কাঁদুক ও। আচ্ছা রঞ্জু কতদিন পর এমনভাবে কাঁদলো? শেষমেশ ও জড়ানো গলায় বলল, ‘কবে ফিরলি?’ ‘এইতো, আজ দুপুরে।’ দু’জন দু’জনকে দেখছি। রঞ্জুর অর্ধেক চুলই পেকে গেছে। ওকে কেমন বুড়ো বুড়ো লাগছে। পুরনো ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম। মানুষের হাতের ছোঁয়া কী ঘরে লেগে থাকে? কে জানে থাকে হয়তো। ঘর সুখ-দুঃখের সাক্ষী তবু আমাদের কাছে কত কিছুই না গোপন করে রাখে। একসময় ওকে বললাম,‘তোর মেয়েকে দেখাবি না?’ ‘ঘুমিয়ে পড়েছে। দাঁড়া দেখি জাগাতে পারি কী না।’ একথা বলে রঞ্জু উঠে গেলো। আমি বসে রইলাম। বুকে ভেতর বাহির ওলট পালট করে দেওয়া ঝড় নিয়ে বসে রইলাম।
ভালোবাসা ব্যাপারটা কী আমি আজো তা নিয়ে ভাবি। দেহের যেই ভুবনে এর জন্ম মন চায় খুঁড়ে দেখি সেই জগতটা কেমন। কিছু কিছু মানুষ বড় দুর্ভাগা হয়। তাদের কপালে লেখা থাকে-তারা তীব্র ভালোবাসা পাবে শুধুই ভালোবাসা পাবে। অথচ শোধ করবার সুযোগ তাদের হবে না। যে গভীর ভালোবাসা নিয়ে মা এখন ভাত বেড়ে অপেক্ষা করছে, যে ভালোবাসা নিয়ে বাবা একসময় অপেক্ষা করতো আমার ঘরে ফিরবার সেই ভালোবাসা নিয়েই বেণু একদিন হাত ধরে বলেছিল, ‘চলুন পালিয়ে যাই।’ সে হাত ছাড়াবার সাধ্য সেই জীবনে আমার হয় নি। আর কখনো এই জীবনে হবে সে সম্ভাবনাও নেই। আসলে ভালোবাসা ফেরত দেওয়ার লোভ হয়তো জীবনে বড় গাঢ় হয়। বড় গাঢ়।
আমরা পালালাম। এমনই এক শীতের রাতে পালিয়ে যেয়ে উঠলাম আমার নানাবাড়িতে। চান্দাখোলা নামের অজ পাড়াগাঁর সেই রাতটি জীবনে বড় দীর্ঘ ছিল। আজকাল প্রায়ই ভাবি একজীবনে মানুষের কয়টা দীর্ঘ রাত থাকে? আহারে, জীবন তার সকল মধুরতা নিয়ে সে রাতে সামনে এসেছিল। তবু সকালটা অন্যরকম হলো। মধুর রাতের সকালগুলো হয়তো অন্যরকমই হয়। খুনের দায়ে স্থানীয় পুলিশ এসে আমায় ধরে নিয়ে গেলো। বেণুর বাবার ক্ষমতার দাপটে একসময় আমার নিজেরই মনে হতে লাগলো হতেও তো পারে খুনের সময় আমি সেখানে ছিলাম! কী লজ্জা কী লজ্জা! বাবার কথা ভেবে সে সময় বড় কষ্ট হচ্ছিল। তবু যে প্রগাঢ় বেদনা সৃষ্টিকর্তা আমার জন্য রেখে দিয়েছিল বাবা আদালতে এসে তা আর বাড়ায় নি ভেবে আজো স্বস্তি পাই। কিন্তু বারো বছর পর ফিরে এসে মনে হচ্ছে-আমার সাজা কেবল শুরু হলো। কে জানে ঋণী মানুষদের হয়তো এমনই মনে হয়।
রঞ্জু ছোট্ট এক ঘুমন্ত পরীকে কোলে করে নিয়ে এলো। বেণুর মেয়ে। যাকে পৃথিবী দেখাতে এনে বেণু নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আচ্ছা ও কী অনেক ক্লান্ত ছিল- যে ক্লান্তিতে মানুষ শুধু গোঙায় তবু শব্দ হয় না? জানা হয়নি। আমার অনেক কিছুই জানা হলো না। বেণুটা এমনই। বড্ড চাপা ছিল। এমন কি ও হাত ধরার আগ পর্যন্ত কখনো বুঝিইনি ভালোবাসা নামের এক মোহন পাখি কেউ আমার জন্য পুষে রেখেছিল। আচ্ছা বেণুর মেয়েটাও কী এমন হবে? হবে হয়তো। বাবার কাধে কী নির্ভরতায় মেয়েটা শুয়ে আছে। দেখতে ভালো লাগছে। বেণুও ঠিক এভাবে কাঁধে মাথা রাখতো। রাখতো নাকি? হঠাৎই বুকে বড় জ্বালা করতে লাগলো। মনে হতে লাগলো রক্তের সাথে কেউ মিশিয়ে দিচ্ছে মরিচ বাটা। আমি ঘুমন্ত পরীর চুলে আদর দিয়ে ফিরে চললাম। যাওয়ার সময় রঞ্জু বলল, ‘এবার অনেক শীত পড়বে নারে?’ আমি ঘোরলাগা ঘোরে বললাম, ‘হ্যাঁ, বড় দীর্ঘ এক শীত।’
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
পন্ডিত মাহী
ঘোরলাগা কিছু মুহুর্ত পার করলাম। কবি হওয়ার সুবিধা বেশ ভালোই কাজে লাগিয়েছেন। এমন একটা কিছু প্রিয়ার চাহনিতে লিখেছিলাম। এই গল্প অনেক ভালো লাগলো। হৃদয়ে জায়গা করে নিলো।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।